সর্বশেষ

নানা শর্তের বেড়াজালে থাকছে রেন্টাল

প্রকাশ :


২৪খবরবিডি: 'স্বল্প মেয়াদের কথা বলে পেরিয়ে গেছে যুগ। তবু বন্ধ হচ্ছে না কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। নানা শর্ত আর যুক্তি দাঁড় করিয়ে বারবার বাড়ানো হচ্ছে এসব প্রকল্পের মেয়াদ। তবে এসব যুক্তি-শর্তকে নিয়মবহির্ভূত এবং অবৈধ বলছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।'

-সম্প্রতি ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও চারটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে 'নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট' শর্তে মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এতে কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট (রেন্টাল ভাড়া) দিতে হবে না বলে দাবি বিদ্যুৎ বিভাগের। তবে প্রস্তাব বিশ্নেষণ করে খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সবচেয়ে সমালোচিত ক্যাপাসিটি পেমেন্টকে এবার ভিন্ন নামে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে পরিবর্তনশীল মেরামত ও পরিচালন ব্যয় (ভেরিয়েবল ওঅ্যান্ডএম) আগের চেয়ে ৬০-৭০ গুণ বাড়িয়ে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবে মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়িয়ে ধরাসহ নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

-তাঁরা বলছেন, বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ না কিনলে কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা সবাই প্রভাবশালী। তাঁরা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) প্রভাবিত করে বিদ্যুৎ ব্যবসা চালু রাখবেন। এ ছাড়া চাহিদা না থাকায় বর্তমানে কমপক্ষে তিন হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকছে। এ বছরের শেষ নাগাদ তিন বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হচ্ছে। তাই তেলভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা অযৌক্তিক।

'মেয়াদ বাড়ার তালিকায় থাকা চার রেন্টাল কেন্দ্র হচ্ছে- পাওয়ারপ্যাক মুতিয়ারার কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের চট্টগ্রাম জুলদায় ১০০ মেগাওয়াট, নর্দান পাওয়ারের রাজশাহী কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট এবং সিনহা পাওয়ারের চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক পাঁচ বছরমেয়াদি এই চার রেন্টাল কেন্দ্র ২০১০ সালে উৎপাদনে আসে। এরপর তাদের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়, যা চলতি বছর শেষ হয়েছে। উদ্যোক্তারা পাঁচ বছর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলেও 'নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট' শর্তে এগুলোর মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হচ্ছে।'

'রেন্টাল-কুইক রেন্টালে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে গত ১২ বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে সরকাররের। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা উদ্যোক্তাদের দেওয়া হয়, এটাই ক্যাপাসিটি চার্জ।
বাড়ানোর পক্ষে বিদ্যুৎ বিভাগের যুক্তি :মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো প্রস্তাবে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক মোট ৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৪৫৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি মিলে মোট ১ হাজার ১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৩টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে। তবে বিতরণ ও সঞ্চালন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, দাম কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ 'নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট' শর্তে বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেসভিত্তিক ৪৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি এবং গ্যাসভিত্তিক ২১৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ এই শর্তে বাড়ানো হয়েছে। প্রস্তাবে দাবি করা হয়, সেচ ও গ্রীষ্ফ্ম মৌসুম বিবেচনায় জরুরি প্রয়োজনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে বলা হয়, গত বছরের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গ্যাস ঘাটতির কারণে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক রেন্টালকেন্দ্রগুলো চালু রাখতে হবে।'

'প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ৯৯৫ মেগাওয়াট হলেও অপ্রতুল গ্যাসের কারণে বর্তমানে ৫ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া বাখরাবাদ-মেঘনাঘাট-হরিপুর ৪২ গ্যাস সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ ২০২৪ সালের জুনের আগে শেষ হবে না। ফলে মেঘনাঘাট এলাকায় নির্মাণাধীন বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০২৪ সালের আগে উৎপাদনে আসবে না। তাই এই চার কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন।'

-যেসব পরিবর্তন আসছে :চার কেন্দ্রের রেন্টাল চার্জ ছিল প্রতি মাসে কিলোওয়াটপ্রতি ১৩ ডলার। ফার্নেস অয়েলের দাম ছিল ৪২ টাকা লিটার। নতুন প্রস্তাবে রেন্টাল চার্জ থাকছে না। এর বদলে ফিক্সড অপারেশন ও মেইনটেন্যান্সের জন্য কিলোওয়াট-ঘণ্টায় তিন টাকা ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে পরিবর্তনশীল অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স খরচের জন্য আরও ২৫ পয়সা ধরা হয়েছে, যা আগে ছিল প্রায় দশমিক ৫ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি কিলোওয়াটে জ্বালানি খরচ গড়ে ১৩ টাকা ৭০ পয়সা যুক্ত হবে। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির খরচ হবে প্রায় ১৭ টাকা।'

-অযাচিত যুক্তি : পিডিবি ও বিদ্যুৎ খাতের একাধিক সাবেক ও বর্তমান কর্মকতার সঙ্গে এই প্রস্তাব নিয়ে ২৪খবরবিডির কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, রেন্টাল চার্জ থাকছে না ঠিকই; কিন্তু ফিক্সড অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স খরচের নামে একটা ব্যয় বিলে যুক্ত করা হয়েছে। হিসাব করলে এটা রেন্টাল চার্জের চেয়ে বেশি পড়ে। কারণ আগে প্রতি ইউনিটে যে রেন্টাল চার্জ গড়ে দুই টাকা ছিল, ফিক্সড অপারেশন ও মেইনটেন্যান্সের নামে তা তিন টাকা করা হয়েছে। ভেরিয়েবল অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স খাতে খরচ দশমিক ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৫ পয়সা করা হয়েছে, এগুলো অযৌক্তিক। তাঁরা আরও বলেন, এখনকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। এখন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে রয়েছে। ডিসেম্বরে কয়লাভিত্তিক ২-৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। তাই রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁরা আরও জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও প্রস্তাবে তা ৪০ হাজার মেগাওয়াট বলা হয়েছে। প্রস্তাবে উদ্যোক্তাদের ভালোর সার্টিফিকেট দেওয়া হলেও একাধিক উদ্যোক্তাকে জরিমানা দিতে হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে অভিযোগের শুনানিও চলেছে।

নানা  শর্তের  বেড়াজালে  থাকছে  রেন্টাল

'জানতে চাইলে বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ না কিনলে টাকা পাবে না এমন শর্তে হলে চুক্তি নবায়ন খারাপ হয় না। তবে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স খরচ বেশি ধরা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।'

-কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতেই দায়মুক্তির বিশেষ আইনে দরপত্র ছাড়াই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয়েছে। বারবার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এখন নতুন শর্তের আবরণে আবারও মেয়াদ বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। বিদ্যুৎ না কিনলে বিল পাবে না এমনটি বলা হলেও বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী পিডিবির সঙ্গে যোগসাজশে এসব কেন্দ্র চালু রাখবেই। কারণ পিডিবির বিরুদ্ধে কম খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে ব্যয়বহুল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার অভিযোগ বহু পুরোনো। তাই যে শর্তই দেওয়া হোক, রেন্টাল রেন্টালের মতোই চলবে।

Share

আরো খবর


সর্বাধিক পঠিত